ফিলিস্তিনের সানা টিভির একটা নাশিদ সিরিজ আছে। উ’দাতু লাইলা নাম। কাহিনিটা লাইলা নামের একটা মেয়েকে নিয়ে। সিরিজে ফিলিস্তিনে তার যাপিত জীবনের সুখ দুঃখ, তার আবাসস্থল হারানো, দেশ থেকে উচ্ছেদ হওয়া, দখলদার বাহিনীর হাতে আত্মীয়-স্বজনের মৃত্যুর চিত্র সব সচিত্র দেখানো হয়। সিরিজটা দেখেছিলাম সেই ছোটবেলায়। হেফজখানায় পড়াকালীন সময়ে।
আমার ছোটমনে সিরিজটা বেশ প্রভাব ফেলেছিলো। দেখলে কান্না পেয়ে যেতো আমার। বড় হবার পরেও সিরিজের নাশিদগুলো আমার সংগ্রহে ছিল। এখনও আছে। মুখস্ত হয়ে গেছে প্রায়। এখন কন্যাকে সাথে নিয়ে দেখি প্রায়ই। কন্টেট বুঝিয়ে দিই তাকে। যেটুকু বুঝে তাতে দেখলাম তার মন খারাপ হয়।
সুপ্রভাত ফিলিস্তিন বইয়ের কাহিনিটাও প্রায় সেইম। বইটি পড়তে পড়তে বারবার লাইলার কাহিনি মনে পড়ছিলো আমার। আমাল আর লাইলার জীবনের গল্পগুলো একই সুতোয় গাঁথা। যেন একটি গল্পের অবিচ্ছেদ্য অংশ। আমালের পূর্বপুরুষ থেকে নিয়ে আমালের পরবর্তী প্রজন্ম পর্যন্ত তাদের জীবনের যে গল্প চিত্রিত হয়েছে বইটিতে তার অনেকটাই আমি দেখেছি সচিত্র।
সানা টিভির নাশিদ সিরিজগুলোতে। তাই বইটি পড়তে গিয়ে আমালের জীবন কাহিনি যেন আমার কল্পনার মনিটরে ভেসে উঠেছে বারবার। আমালের দাদা, বাবা, ভাই, মাকে হারানোর গল্প পড়তে গিয়ে কখন যে চোখ ভিজে উঠেছে আমি নিজেও জানি না। কাহিনি যতদূর এগিয়ে যায় আমার কান্নার দমক তত বাড়ে। যেখানেই বসে পড়ি আমার কেবলই কান্না পায়। তাই ঘরের একলা কোণে বসে পড়তে হলো।
বই পড়ে কাঁদছি ব্যাপারটা অন্যরা কোন দৃষ্টিতে দেখবে ভেবে সংকোচ হচ্ছিলো। তাই তিনদিন বেশীরভাগ সময় একলা রইলাম। সফরসঙ্গী হিসেবে বইটাকে নিয়েছিলাম। পড়তে গিয়ে ভাবলাম—নাহ এই বই আনন্দের সময়ে পড়া যাবে না। বাসায় গিয়ে স্থির হয়ে পড়তে হবে। হুদার সাথে আমালের বিচ্ছেদে কান্নার দমক এতটা বেড়ে গিয়েছিলো যে,আই লস্ট মাই কন্ট্রোল!
জীবন প্রতিক্ষণে হুমকি ও অনিশ্চয়তার মুখে থাকলেও প্রেমের ফুল ফোটার পথে তা বাধা হতে পারে না। পাথুরে জীবনেও যে ফুটে ভালোবাসার অনিন্দ্য পুস্প এই কথাটিকে ইউসুফ-ফাতিমা, হুদা-উসামার ভালোবাসার অধ্যায় যেন বারবার প্রমাণ করে যায়।
জীবনের সুখ নদীর পাশাপাশি বইতে থাকা দুঃখ নদীটিতেও মাঝেমধ্যে লাগে ভাটার টান। মাজিদের হাত ধরে আমালের জীবনে যে সুন্দর মুহূর্তগুলো এসেছিলো সেগুলো পড়ে আমার মনে হয়েছিলো এবার হয়তো আমালের জীবনে আসবে শান্তি ও সুন্দরের সুর্যোদয় । কিন্তু হায়! আমি ভুলে গিয়েছিলাম ফিলিস্তিনিদের জীবন মাত্রই দুঃখগাঁথার পাঠ। তাই আমাকে হোঁচট খেতে হলো এখানে এসে। মাজিদের মৃত্যু আমাকে নাড়া দিয়ে গেলো প্রচন্ডভাবে। আমি কোথায় গিয়ে একটু সান্ত্বনা খুঁজবো! বিহবলতায় আচ্ছন্ন হয়ে গেলো আমার মন। সবশেষে আমার জন্য অপেক্ষা করছিলো আরও আরও বিষাদ, কষ্ট। আর তা হলো আমালের মৃত্যু। ঠিক এই জায়গাটায় এসে দেখলাম চোখের পানিতে ভিজে গেছে আমার দোপাট্টার বেশ কিছু অংশ।
আর তখনই মনে মনে ভেবে নিলাম আমার জীবনে দ্বিতীয়বার এই বইখানা পড়ার দুঃসাহস আমি দেখাতে পারবো না। অথচ ভীষণ ভালোলাগার বইগুলো আমি একবার নয় বেশ কয়েকবার পড়ি।
যুদ্ধ প্রেম ও বিরহের উপাখ্যান—এই তিনটির সমন্বয়ে লেখা এই দারুণ উপন্যাসটি আমার আর দ্বিতীয়বার খুলে দেখা হবে না। রেখে দিলাম সযত্নে আমার পরবর্তী প্রজন্মের জন্য। আমার পরে কারোর যদি গভীর রাতে কপোল ভেজানোর ইচ্ছে হয় সে যেন এই বইখানা পড়ে।
বইয়ের অনুবাদ নিয়ে মোটামুটি নেগেটিভিটি শুনেছি বই পড়ার আগে। আমার কাছে অনুবাদ ভালোই লেগেছে। মর্মস্পর্শী এ উপন্যাসটির অনুবাদও আমার হৃদয়কে মোটামুটি স্পর্শ করতে সক্ষম হয়েছে। তাই রেটিংয়ে দশে দশ দিতে না পারলেও খারাপ বা নেগেটিভ টাইপের কিছু বলার নেই আমার। শুধু বলবো কন্টেন্ট ও অনুবাদ মিলিয়ে আমার পয়সা উসুল।